মঙ্গলবার, এপ্রিল ২২, ২০২৫

ফলোআপ রিপোর্টঃ অবশেষে ‘জাহাঙ্গীরমুক্ত’ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল

- Advertisement -bsrm

মোহাম্মদ ইউসুফ *

“দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল থেকে পদত্যাগ চাই” লেখা ব্যানারে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারিরা

পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না, যেমন কর্ম তেমন ফল যে ভোগ করতে হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালের স্বঘোষিত মা-বাপ জাহাঙ্গীর চৌধুরী। তাকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। দুদশক ধরে যাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণ-বঞ্চনার স্টিমরোলার চালিয়েছেন সেই তারা-ই ফুঁসে ওঠেছেন তার অন্যায়-অত্যাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। গতকাল (৫ অক্টোবর) “দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী ফ্যাসিস্ট জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল থেকে পদত্যাগ চাই” লেখা ব্যানার নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারিরা জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ১৪ দফা দাবী আদায়ে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তার প্রতিকৃতিতে থুথু নিক্ষেপ ও জুতোপেটা করেছেন। এসময় আশপাশের কৌতুহলী লোকজন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও জড়ো হয়। জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে নানান অশ্লীল স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তার দুর্নীতির সহযোগী হাসপাতাল পরিচালক নওশাদ আজগর চৌধুরী, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল ও নিরীক্ষা কর্মকর্তা ইয়াছিন চৌধুরী; শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হন তারা। সেনাবাহিনী ও পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে সেনা ও পুলিশ পাহারায় অবরুদ্ধ কর্মকর্তারা হাসপাতাল ত্যাগ করেন।এসব দুঃসংবাদ পেয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরী হাসপাতালে ঢোকেননি। আত্মরক্ষার্থে তার অন্য অনুসারীরাও পালিয়ে যান। সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ‘জাহাঙ্গীরমুক্ত’ হয় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল। অবাঞ্চিত জাহাঙ্গীর ও তার বাহিনী যাতে হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করতে না পারে- সে জন্যে কর্মচারিরা পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন।call me 01675040128

গতকাল (৫ অক্টোবর) দুপুর ১টায় ছিল জাহাঙ্গীর চৌধুরীর নতুন অবৈধ পকেট কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। মেয়াদোত্তীর্ণ বহিস্কৃত ডায়াবেটিক সমিতি অবৈধভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৫ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর তা স্থগিত ঘোষণা করেছে। চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফরিদুল আলম স্বাক্ষরিত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের এক পরিপত্রে বলা হয়, “সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন নিবন্ধিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি’র বর্তমানে কোনো অনুমোদিত কার্যকরী কমিটি নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অফিস আদেশ নম্বর ৪১.০১.০০০.০৪৬. ২৭.০২৫.২২.১০০ তারিখ ২৫.০১.২০২৩ মূলে সংস্থার তৎকালীন কমিটিকে সাময়িক বরখাস্তপূর্বক স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ)অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর বিধান মোতাবেক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। কাজেই সংস্থার অননুমোদিত কার্যকরী কমিটির সাধারণসভা আহবান ও নির্বাচন আয়োজনের কোনো বৈধতা নেই। তাছাড়া সংস্থার কার্যক্রম বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নম্বর ১৬১০/২০২৩ চলমান আছে। এমতাবস্থায় আদালতের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম ডায়ঢাবেটিক সমিতির নির্বাচনসংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখার অনুরোধ করা হয়।” কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে জাহাঙ্গীর চৌধুরী তার পদলেহী লোকজন নিয়ে নতুন অবৈধ কমিটি গঠন করে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। বিক্ষুব্ধ কর্মচারিদের আন্দোলনের মুখে সংবর্ধনা পণ্ড হয়ে যায়। হাসপাতাল এখন বলা যায় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের নিয়ন্ত্রণে।

ডায়াবেটিক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা যে ১৪দফা দাবীতে আন্দোলনে নেমেছেন-SIBL

১. দুর্নীতিবাজ জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও তার সীমাহীন আত্মীয়করণ থেকে ডায়াবেটিক হাসপাতালের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তি চায়। আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই।

২. গত ২৪ বছরের প্রভিডেন্ট ফান্ডের কয়েক কোটি টাকার হিসাব চাই। প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারির প্রভিডেন্ট ফান্ডের আলাদা পাশবই চাই।

৩. চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছ থেকে প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের নামে কেটে নেয়া টাকার হিসাব চাই এবং লভ্যাংশসহ আমাদের টাকা আমরা ফেরত চাই।

৪. অবসরকালে অর্জিত ছুটিসহ গ্র্যাচুইটির ঘোষণা দেয়ার পরও তা চালু না করায় সকল চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারি ক্ষুব্ধ।

৫. অবিলম্বে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গ্র্যাচুইটি চালু করতে হবে।

৬. দ্রব্যমূল্য উর্ধগতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জীবিকা নির্বাহ করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়লেও ফ্যাসিস্ট জাহাঙ্গীর চৌধুরী গত ১০বছর যাবত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কোনো বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করেনি। অবিলম্বে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৭. হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যাতায়াত ভাতা মাত্র ২শ টাকা এবং মেডিকেল ভাতা ২শ টাকা। এত কম ভাতা কোনো প্রতিষ্ঠানে আছে বলে মনে হয় না। অবিলম্বে মেডিকেল ভাতা পনেরোশ টাকা এবং যাতায়াত ভাতা পনেরোশ টাকায় উন্নীত করতে হবে।

৮.  কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি বন্ধ করতে হবে। যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের সকলকে অবিলম্বে স্বপদে বহাল করতে হবে।

৯. জাহাঙ্গীর চৌধুরীর সীমাহীন দুর্নীতির তদন্ত করতে হবে। চিকিৎসাবাবদ তার পরিবারের সদস্যদের কাছে হাসপাতালের কয়েকলাখ টাকা বকেয়া পাওনা অবিলম্বে হাসপাতাল ফান্ডে জমা দিতে হবে।

১০.  হাসপাতালের দৈনিক আয় ১০ লাখ টাকার ওপরে হলেও এ হাসপাতালের ফান্ডে কোনো এফডিআর নেই কেন- তার তদন্ত করতে হবে। কোটি কোটি টাকা কোথায় খরচ হলো- তার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে।

১১. স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ২ কোটি টাকার অনুদান হাসপাতালের ফান্ডে জমা না দিয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ব্যক্তিগত ফান্ডে কেন জমা হলো- তার তদন্ত করতে হবে এবং সমুদয় টাকা হাসপাতালের ফান্ডে জমা দিতে হবে।

১২. প্রতিবার বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল থেকে জাহাঙ্গীর চৌধুরী কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও নিয়ম না মেনে এবারও বিনাভোটে ক্ষমতা যাওয়ার পাঁয়তারা করছিলো কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারিরা এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।

১৩. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনুদানের টাকা জাহাঙ্গীর চৌধুরী তার ব্যক্তিগত ফান্ডে নিয়ে খরচ করে। অবিলম্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক সাড়ে ২৭ লাখ টাকা জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ডায়াবেটিক হাসপাতালের ফান্ডে জমা দিতে হবে।

১৪. অবিলম্বে সমাজসেবা অধিদপ্তরকে চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসকের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরেপক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। নিরেপক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যারা জয়ী হয়ে আসবেন তারাই হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব বোঝে নেবেন।

ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিদ্যমান অবস্থা নিয়ে চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফরিদুল আলমের সাথে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা ডায়াবেটিক হাসপাতালে প্রশাসক নিয়োগের আদেশ দিলেও তা হাইকোর্টে ৬মাসের জন্যে স্থগিত করা হয় এবং পরবর্তীতে আরও ৬মাস স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ অবস্থায় অফিসিয়ালি আমাদের কিছু করার নেই। তারপরও জনস্বার্থে কিছু করা যায় কি না–তা নিয়ে আমাদের ডিজি মহোদয় ও এটর্নি জেনারেলকে লিখিতভাবে জানাবো।”

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে কথা বলতে কর্মকর্তা-কর্মচারি, আজীবন সদস্যবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট লোকজন আজ (৬ অক্টোবর) সকাল ১০ টায় চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলমের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, এ অবস্থায় হাসপাতালে যাতে আর অশান্ত পরিবেশ তৈরি না হয়, রোগীসেবা যাতে কোনোভাবেই বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে সকলকে সজাগ থাকতে হবে। অবিলম্বে হাসপাতাল পরিচালনার জন্যে একটি এডহক কমিটি গঠন করা হবে বলে তিনি সকলকে জানান। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার ও চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালকেও হাসপাতাল পরিস্থিতি লিখিতভাবে জানিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।

গরীব রোগীরা যাতে বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়,স্বল্পমূল্যে পায় চিকিৎসাসেবা- সেই মহৎ উদ্দেশে চট্টগ্রাম শহরে খুলশি’র জাকির হোসেন রোডে সরকারি জায়গায় স্থাপিত হয় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। কিন্তু বাস্তবে উদ্দেশ্য ও নীতি-আদর্শের বিপরীতে হাঁটছে হাসপাতালটি। বিগত দুদশক ধরে এটি বাণিজ্যিক হাসপাতাল হিসেবে চলছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমনই যে, ডায়াবেটিক হাসপাতালটি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত; অবস্থা সঙ্গীন,ইন্সুলিন নিতে হচ্ছে। রোগীসেবার নামে বিভিন্ন তরফ থেকে কোটি কোটি টাকা আসলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না ডায়াবেটিস-রোগীরা। এখানে আইসিইউ/সিসিইউ/এইচডিইউ বিভাগ আছে কিন্তু কোনো  বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই। এ হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির হলেও চিকিৎসালয়টির মা-বাপ মূলত একজনই।সমিতি থাকলেও তা কাগজে কলমে,পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যক্তিবিশেষের হাতে কুক্ষিগত; বাকিরা সব তারই আজ্ঞাবাহী ইয়েসম্যান। প্রতিষ্ঠার পর কিছুদিন ঠিকঠাক চললেও কালক্রমে প্রতিষ্ঠানটির সবকিছু সেই একজনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় । হাসপাতালটির স্বঘোষিত মা-বাপ, হর্তাকর্তা-বিধাতা ও দুর্নীতির বরপুত্র হলেন- চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির বহিস্কৃত সভাপতি  জাহাঙ্গীর চৌধুরী। তার লাগামহীন দুর্নীতির ডালপালা এতই বিস্তার লাভ করেছে যে,পরিণতিতে তা সমাজসেবা অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন অফিস ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পর্যন্ত গড়িয়েছে। সরকারি-বেসরকারি দান-অনুদান ও যাকাত-ফিতরার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ,স্বজনদের হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ ও  বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ এখানে ওপেন-সিক্রেট। বলা যায়, দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল।

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ পাওয়ার পর গত ২১জুলাই ২০২২ সমাজসেবা অধিদপ্তর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহী নেওয়াজের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- সমাজসেবা অফিসার মো. আশরাফ উদ্দিন ও মো. সোহানুর মোস্তফা শাহরিয়ার। কমিটি গঠনের দুমাস পর ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তদন্তকাজ শেষ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন গত ১ ডিসেম্বর ২০২২ সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক  কাজী নাজিমুল ইসলাম বরাবরে জমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে  চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক সাখাওয়াত উল্লাহ বরাবরে  চলতি বছরের (২০২২) আগস্ট  মাসে অভিযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীকে আহবায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে ব্যস্ততার অজুহাতে তদন্ত শুরু করেনি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে অতীতে তিনবার বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় অর্থ কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ, মানববন্ধন থেকে শুরু করে একাধিকবার তদন্ত হয়। কিন্তু বরাবরের মতো তিনি নানা ফন্দিফিকির অবলম্বন করে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

সমাজসেবা ও দুর্নীতি দমন বিভাগে দেয়া অভিয়োগপত্রে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর চৌধুরী ২০০১ সালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর উদ্দিনকে বিনা কারণে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে হটিয়ে ওই পদে আসীন হন। সেই তখন থেকেই এখন পর্যন্ত প্রভাব খাটিয়ে গঠনতন্ত্রকে নিজের সুবিধামতো সংশোধনী এনে সাধারণ সম্পাদক ও  বর্তমানে সভাপতি পদে বহাল আছেন। ডায়াবেটিক হাসপাতালে প্রতিদিন ৯/১০ লাখ টাকা আয় হলেও হাসপাতালের নামে কোনো আয়-ব্যয়ের রেজিস্ট্রার বই নেই। আয়-ব্যয়ে নেই কোনো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। গঠনতন্ত্রের ১২ (ঘ) ধারা মোতাবেক ব্যাংক হিসাব- যা সমিতির নামে কোষাধ্যক্ষ সমিতির যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ করার কথা। ১৭ (গ) ধারা অনুযায়ী ব্যাংক হিসাব- যা সমিতির নামে কোষাধ্যক্ষ নিজে এবং সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যে-কোনো একজনসহ দুজনের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালিত হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করা হয় না। এখানে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ এর সব দায়িত্ব পালন করেন সভাপতি নিজেই। মূলত সভাপতি-ই হাসপাতালের সর্বেসর্বা। কোষাধ্যক্ষের বাসায় গিয়ে ‘ব্ল্যাংক চেক’-এ স্বাক্ষর নিয়ে আসেন জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী।

অভিযোগপত্র থেকে আরও জানা যায়, গত ২৮জুন ২০২১ জনতা ব্যাংক লিমিটেড ও ইউসিবিএল, খাতুনগঞ্জ শাখা কর্তৃক দায়েরকৃত অর্থঋণ মামলায় চট্টগ্রামের চকবাজার থানা পুলিশ জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। থানা থেকে নিজেকে ছাড়ানোর কথা বলে একইদিনে হাসপাতালের হিসাব থেকে ৩৯লাখ টাকা উত্তোলন করে নেয়- যা এখনও পরিশোধ করেননি।গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে চেক পাশ হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। যেখানে সাধারণ সম্পাদক ইহজগতে নেই, সভাপতি জেলে থাকাকালীন সভাপতি ও কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষরে কীভাবে চেক পাশ হয়ে যায়- এমন প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই।

এদিকে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড ,আন্দরকিল্লা শাখায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের নামে হিসাব খুলে জাহাঙ্গীর চৌধুরী নিজেই পরিচালনা করেন- যা সংগঠনের গঠনতন্ত্রীপরিপন্থী ও বেআইনী। এ  হিসেবে নামে-বেনামে হাসপাতালের অনুকূলে যত টাকা আসে, সব টাকা তিনি উত্তোলন করে নেন। ২০১৫ সালে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহারের জন্যে হাসপাতাল হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করে তা আর পরিশোধ করেননি। ২০১৮ সাল থেকে সরকার চট্টগ্রাম জেনারেল ডায়বেটিক হাসপাতালের জন্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যে টাকা অনুদান হিসেবে পাঠায়, তা-ও জাহাঙ্গীর চৌধুরী আত্মসাৎ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার থেকে আবারও ৫০লাখ টাকার চেক এসেছে (স্মারক নম্বর- ৪৫.০০.০০০০.১৬২.৯৯.০০৭.২১.৭৫ চডাস/২০২২/১১৮ তারিখঃ ০২.০৩.২০২২ খ্রিস্টাব্দ)। বিভিন্ন পরামর্শকদের নামে ঋণ দেখিয়ে  তিনি হিসাব মিলিয়ে রাখেন। অথচ যাদের নামে ঋণ দেখানো হয়, সেসব  চিকিৎসক নিজেরা-ই জানেন না- তাঁরা ঋণ নিয়েছেন। চিকিৎসকদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেন পিআরও শিবু প্রসাদ চৌধুরী। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি পড়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর। তিনি এ বি ব্যাংক লিমিটেড এর খুলশী শাখায় কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা বেআইনিভাবে উত্তোলন করে কমার্স ব্যাংক থেকে নেয়া তার ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধে ব্যয় করেন- যা এখনো পরিশোধ করেননি। ২০১৯-২০ রোটারিবর্ষে রোটারি ক্লাব অব চিটাগং ইস্ট থেকে জাহাঙ্গীর চৌধুরী রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮২ এর গভর্নর পদে নির্বাচন করার সময় হাসপাতাল ফান্ড থেকে অবৈধভাবে প্রায় ২কোটি.৫০লাখ টাকা ব্যয় করেন- যা এখনও ফেরত দেননি। অন্যদিকে তিনি বায়ো-ট্রেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে অবৈধ লেনদেনে লিপ্ত হয়ে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের টাকা লোপাট করেছেন। হাসপাতালের টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ইটিটি মেশিন কেনার নামে হাসপাতাল তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উত্তোলন করা হলেও মেশিন কেনা হয়নি; চালু করা হয়নি ইটিটি বিভাগ।  জাহাঙ্গীর চৌধুরী এলইডি টিভি ও ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা-সফটওয়্যার বাণিজ্যও করছেন।শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম আইন কলেজের অধ্যক্ষ পদ পাকাপোক্ত করতে তিনি হাসপাতাল তহবিলের টাকায় আইন কলেজের শিক্ষার্থীদের সুবিধার জন্যে ট্রাস্ট সীট করে দেন। তিনি বহু বছর থেকে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক আজিজ, বাসাবাড়ির কাজের ছেলে মিজান ও রকি’র বেতন হাসপাতাল তহবিল থেকে পরিশোধ করে আসছেন। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বন্দরটিলা শাখা স্থানান্তরের অজুহাত দেখিয়ে  সহ-সভাপতি  এস এম শওকত  হোসেন ও প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমানের সহযোগিতায় ২০লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে সভাপতির বিরুদ্ধে। হাসপাতালটিতে কেনাকাটা থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেনসংক্রান্ত কোনো কাজে দরপত্র কিংবা আইনকানুন পালন করা হয় না। হাসপাতালের একটি ৬তলা ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সহ-সভাপতি এস এম শওকত হোসেনকে এ নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান করে বহুতল ভবন তৈরির কাজ শুরু করা হয়। সিডিএ’র অনুমতি না নিয়ে  ৫তলার নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে ৬তলা ঢালাইয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি সিডিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগ অবহিত হয়ে গত ১৯নভেম্বর ২০২২ নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকলেও হাসিনা সরকারের পতনের আবার ভবননির্মাণের কাজ শুরু করেন।অভিযোগ করা হলে সিডিএ আবার নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়।

হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স এর অপব্যবহার

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে এস এইচ আর শিপিং কোম্পানি ও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক দানকৃত দুটি অ্যাম্বুলেন্স আছে। অ্যাম্বুলেন্স দুটি হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা ব্যবহার করেন। হাসপাতালের “মা-বাপ” জাহাঙ্গীর চৌধুরী, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা  আমান উল্লাহ আমান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী মূলত হাসপাতালে আসা-যাওয়া ও ব্যক্তিগত কাজে অ্যাম্বুলেন্স দুটি  হরহামেশাই ব্যবহার করেন। এ তিনজনের বাসার সামনে অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এ হাসপাতালে রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের তেমনএকটা রেকর্ড নেই।

স্বজনপ্রীতি

বিগত সময়ে (২০০২-২০২০) জাহাঙ্গীর চৌধুরী অবৈধভাবে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তার ৪৬জন আত্মীয়স্বজনকে হাসপাতালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেন। তার ভাতিজা প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান উল্লাহ আমান, আত্মীয় অডিট অফিসার মো. ইয়াছিন, অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. আনোয়ার, মো. মোজাম্মেল, মো. রবিউল, আপন ভাগনি সিনিয়র মেডিকেল অফিসার(গাইনী) ফারিয়া বিনতে আলী, সহ-সভাপতি শওকতের শ্যালিকা সনোলজিস্ট ডা. শেহরিন সামিহা ইসলাম (এনায়েতবাজার শাখায় কর্মরত), যুগ্ম সম্পাদক শাহনেওয়াজ এর মেয়ে ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. রিজওয়ানা, এক্সিকিউটিভ কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ’র শ্যালক ইনডোর সুপারভাইজার মো. মাজহার ইসলামসহ আরও অনেকে।

পিয়ন থেকে প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমান

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর ভাতিজা আমান উল্লাহ আমান বর্তমানে হাসপাতালের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। পিয়ন থেকে ক্যাসিয়ার, অতঃপর জনসংযাগ কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক বিভাগের ক্লার্ক এবং অবশেষে বর্তমান পদে আসীন হন আমান। জাহাঙ্গীর চৌধুরীর পক্ষে আমান তার বিশেষ “কামান ” ব্যবহার করে হাসপাতালের হিসাব-নিকাশ, স্টোর, প্রিন্টিং, কেনা-কাটা থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। স্টোরের সমস্ত মালামাল আমান তার মনোনীত দোকান ও কোম্পানি থেকে কেনেন। হাসপাতালে ব্যবহারের সকল যন্ত্রপাতি কেনা ও ল্যাবরেটরির বিভিন্ন মালামাল ও রিএজেন্ট কেনার দায়িত্বও আমানের। কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্য করে আমান জিরো থেকে এখন হিরো; কোটি কোটি টাকার মালিক । বিএস এন্টারপ্রাইজ ও গ্রাফিয়া নামে দুটি প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান আছে তার। রোগীর হাজার হাজার গাইডবইসহ যাবতীয় প্রিন্টিংয়ের কাজ এখানে করা হয়। দুটি প্ল্যাট বাড়ি, ৮টি সিএনজি অটোরিক্সা, জমিজমা কিনে অঢেল সম্পদের মালিক আমান।

ব্যক্তিস্বার্থে হাসপাতালের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনঃ

দীর্ঘ দেড়যুগ ধরে জাহাঙ্গীর চৌধুরী সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে এবং গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-১৫ এর ধারা (কোরাম পূরণের জন্যে এক-তৃতীয়াংশ অথবা কমপক্ষে ৫১জন সদস্যের উপস্থিতি থাকা বাধ্যতামূলক) ভঙ্গ করে এ ধারার নিয়ম কোনোদিনও না-মেনে শুধুমাত্র নিজস্বার্থে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে আসছে।গঠনতন্ত্রের যেসব ধারা বেআইনি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়-

১. কর্মচারিদের মধ্য থেকে আজীবন সদস্য হিসেবে যারা ভোটার তাদের ভোটাধিকার বিলুপ্ত করা হয়। কারণ-বেশিরভাগ কর্মচারি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দুর্ব্যবহার, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে তাকে পছন্দ করতো না এবং নির্বাচনে ভোট দিতো না। কিন্তু উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- প্রতিবার এজিএম-এ কোরাম পূরণের লক্ষ্যে একই কর্মচারিদের জোরপূর্বক উপস্থিত থাকতে বলা হয় এবং যেসব কর্মচারি উপস্থিত থাকতো না, বিভিন্ন কলাকৌশলের মাধ্যমে তার আজ্ঞাবাহী কর্মচারি শিবু প্রসাদ চৌধুরীকে দিয়ে রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর নেয়।

২. নির্বাহী কমিটিতে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে দমিয়ে রাখা ও বিরুদ্ধ প্যানেলকে দুর্বল করার জন্যে আবার গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়। এর মূল লক্ষ্য- নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন কেউ চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে আর চাকরি করতে পারবে না। অথচ বর্তমানে তার নিজের-ই ৪৬জন আত্মীয়স্বজন হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন।

৩. ২০০২ থেকে ২০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের পদে বহাল থেকে নিজের একক সিদ্ধান্তে সকল কাজ পরিচালনা করতেন। তৎকালীন সভাপতির মৃত্যুজনিত কারণে পদটি খালি হওয়ায় তিনি লোভের বশবর্তী হয়ে বেআইনি প্রক্রিয়ায় এ ‘শূন্য সভাপতি’ পদ দখল করে নেন। সভাপতির পদ দখল করে তিনি ক্ষান্ত হননি, সেই সাথে হাসপাতালের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যেসকল ক্ষমতা সাধারণ সম্পাদকের ছিল, তা পরিবর্তন করে সভাপতির কাছে নিয়ে আসে- যা এখনও পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে অনুমোদনহীন কমিটি দিয়ে এ হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে।

৪. ২৯মার্চ ২০২২ খ্রিস্টাব্দে প্রহসনের এজিএম-এ (এ এজিএম-এ কোনো আজীবন সদস্যকে বার্তা প্রেরণের প্রয়োজনবোধও করেনি) চতুর্থ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অত্যন্ত হাস্যকর ও ন্যাক্কারজনকভাবে যুক্তি সাজালো যে, কোনোকালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে চাকরি করেছেন কিন্তু আজীবন সদস্য, এবং তিনি যদি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন অথবা অবসরে যান তবে তিনি কখনো হাসপাতালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। অর্থাৎ তার ইচ্ছেমাফিক, জোরপূর্বক ও বেআইনিভাবে পরিবর্তনকৃত প্রথম ও চতুর্থ নিয়ম অনুসারে হাসপাতালে চাকরিচ্যুত কোনো ব্যক্তি ‘নির্বাহী নির্বাচনে’ ভোট দিতে পারবে না কিংবা অব্যাহতি নিলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তার এসব হাস্যকর নিয়মও সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনুমোদন পায়নি। দেশে কোনো সামাজিক ও সেবামূলক সংগঠনের মেয়াদ ৪বছর আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু জাহাঙ্গীর চৌধুরী নিজের স্বার্থে সেই কাজটি করেছেন। সংশোধিত গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ-১৩ এর ১(ক) –এ  কমিটির মেয়াদ ৪বছর করা হয়েছে- যা আগে ছিল তিনবছর।

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে যারা-ই উচ্চবাচ্য করেছেন তাদের চাকরি খোয়াতে হয়েছে। ২০০৮ থেকে এ  পর্যন্ত যে ৭০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারিকে জোরপূর্বক পদত্যাগে ও বেআইনিভাবে চাকরি থেকে অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন। যে কজনের নাম  পাওয়া গেছে তাঁরা হলেন- ১. ডা. মাসুদ আহমদ ২.  হাসপাতাল পরিচালক ডা. নওশাদ আহমেদ খান ৩.স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. নার্গিস রোজেলা ৪. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. আবসার ৫. ডা. ফাহাদ গণি ৬. বিশেষজ্ঞ ডা. মেহেদী ৭. বিশেষজ্ঞ ডা. মোমেন ৮.এনেস্থেসিয়া ডা. ইমরান ৯. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শিরিন ১০. ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ ডা. শাহেদ ১১. মো. নাজমুল (প্রশাসন) ১২. হাসপাতাল পরিচালক ডা. মজুমদার ১৩. প্রধান পুষ্টিবিদ ও উপপরিচালক হাসিনা আক্তার লিপি ১৪. নাসরিন ১৫. দন্ত বিশেষজ্ঞ ডা. উত্তম কুমার তালুকদার ১৬. পারভিন ১৭. ডা. টিটু বিশ্বাস ১৮. চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজামান মনসুন খান ১৯. চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুমি ২০. অর্থোপেডিক্স ডা. হিমাদ্রী ২১. মেডিকেল বিভাগীয় প্রধান ডা. মাহবুবা আক্তার ২২. সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. ইসতেয়াক আজিজ খান ২৩. মেডিকেল অফিসার ডা. শারমিন আফরোজ ২৪. মেডিকেল অফিসার ডা. গুলশান আরা বেগম ২৫. মেডিকেল অফিসার ডা. হাসান আল মামুন ২৬. প্রশাসনিক প্রধান মো. মজনুন চৌধুরী ২৭. প্রশাসনিক অফিসার মো. বোরহান উদ্দিন ২৮. পার্সোনাল অফিসার আবদুল্লাহ মিয়া ২৯. প্রজেক্ট অফিসার আনিসুর রহমান ৩০. প্রধান বায়োকেমিস্ট অফিসার মো. কামরুল হাসান ৩১. নিরাপত্তা অফিসার মো. শাহাবুদ্দিন ৩২. সিনিয়র সমাজকল্যাণ অফিসার আঞ্জুমান আরা বেগম ৩৩. সিনিয়র সমাজকল্যাণ অফিসার জলি বড়ুয়া ৩৪. পুষ্টি অফিসার আয়েশা বেগম ৩৫. ফার্মেসী বিভাগ সহকারী শামীম আরা বেগম ৩৬. ফার্মেসী বিভাগ সহকারী শাহনাজ পারভিন ৩৭. দন্ত বিভাগ সহকারী জয়া ভট্টাচার্য ৩৮. ইলেকট্রিশিয়ান মো. মেহেদী হাসান ৩৯. সেনিটারি ও প্লাম্বার মো. শহিদুল্লাহ ৪০. অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার মো. রিপন মিয়া ৪১. অফিস সহকারী মো. বেলাল হোসেন ৪২.মালি মো. মাকসুদ উল্লা  ও ৪৩. মালি মো. ইব্রাহীম মিয়া ৪৪. ফার্মাসিস্ট অ্যাসিসট্যান্ট উত্তম কুমার গুপ্ত ৪৫. ফার্মাসিস্ট অ্যাসিসট্যান্ট কল্যাণ চৌধুরী ৪৬. ফার্মেসী অ্যাটেনডেন্স মো. হাসান ৪৭. অ্যাটেনডেন্স মিনতি দাস ও ৪৮. আয়া তমা দাশ । ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রাপ্ত গ্র্যাচুইটি/প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আত্মসাতের উদ্দেশে এদের বেআইনিভাবে জোরপূর্বক পদত্যাগ ও চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করেন। এখন পর্যন্ত চাকরিচ্যুতদের কারো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাতেগোণা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি ছাড়া চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের স্বাভাবিকভাবে অবসরে যাওয়া ও তাদের পিএফ ফান্ডের টাকা পাওয়ার কোনো রেকর্ড নেই। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি অবসরে যাওয়ার আগে তার বিরুদ্ধে মনগড়া অভিযোগ তৈরি করে এমন এক পরিস্থিতি করা হয় যে, ওই কর্মকর্তা-কর্মচারিকে হয় টারমিনেট নয় তো পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এ অমানবিক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা কেউ পিএফ এর টাকা পাননি। এ নিষ্ঠুর ও অমানবিক পন্থা অবলম্বন করে জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে পিএফ ফান্ডের কয়েক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। আগে পিএফ ফান্ড এর টাকা আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে জমা হতো, এখন জমা হয় না। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কাছ থেকে যথারীতি পিএফ ফাণ্ডের বিপরীতে টাকা কেটে নিলেও তা কোথায় জমা হয়- তা কেউ জানেন না।

গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হাসপাতালের জন্যে যেকোনো যন্ত্রপাতি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে পত্রিকার মাধ্যমে দরপত্র আহবানের নিয়ম থাকলেও জাহাঙ্গীর চৌধুরী একক সিদ্ধান্তে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছেন এবং কেনা-বেচার বিল-ভাউচার তিনি কখনও স্টক রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করেননি। পরে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে দেয় চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার বেলাল উদ্দিন। সংগঠনের অনুচ্ছেদ-১৭ খ অনুযায়ী “সদস্য অন্তর্ভুক্তি ফি, এককালীন অনুদানসহ বিভিন্ন দান-অনুদান, সরকারি-বেসরকারি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সসংস্থার সাহায্য, সমিতির নির্দিষ্ট কোনো প্রজেক্ট থেকে অর্জিত অর্থ, সমিতির আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম থেকে প্রাপ্ত অর্থ, সমিতির বিভিন্ন রোগীসেবা থেকে প্রাপ্ত অর্থ, সেবামূলক অন্যান্য বৈধ উৎস থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে সমিতির তহবিল গঠন করা হবে। তহবিলসহ সকল সম্পত্তি সমিতির নামে অর্জিত, স্বীকৃত ও পরিচালিত হবে। সকলপ্রকার অর্থ-আয় সমিতির নির্ধারিত রশিদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা যাবে এবং প্রাপ্ত আয় সমিতির নামে নির্ধারিত ব্যাংক হিসেবে জমা হবে। জাহাঙ্গীর চৌধুরী এসব নিয়ম-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে সমিতি উপার্জিত যাবতীয় আয়ের কোটি কোটি টাকা সমিতির নামে নির্ধারিত ব্যাংকে না রেখে নিজ করায়ত্বে রেখে যাচ্ছেতাইভাবে হরিলুট করে আসছেন। রোগীস্বার্থ পদদলিত করে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা হচ্ছে, জাহাঙ্গীর চৌধুরী ঢাকা বারডেম হাসপাতাল ও অন্যান্য দাতাসংস্থা থেকে প্রাপ্ত জীবন রক্ষাকারী ইনসুলিন নিজের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ ও বিভিন্ন ফার্মেসীতে বিক্রি করে দেন- এমন অভিযোগ সকলের মুখে মুখে। Novo Nordisk কোম্পানি প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ হাসপাতালের রোগীদের HbA1c টেস্ট করতে প্রতিমাসে ৭/৮লাখ টাকা অনুদান দিত। অনুদানের এ টাকা রোগীদের জন্যে ব্যয় না করে পুরোটাই আত্মসাৎ করার খবর পেযে এই কোম্পানি ২০২২ সালের জুনমাস থেকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। ফার্মেসীতে ন্যায্যমূল্যের বদলে চড়াদামে ওষুধ বিক্রি হয় বলে রোগীদের অভিযোগ। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল নামে দাতব্য হাসপাতাল হলেও প্রাইভেট হাসপাতালের মতো গলাকাটা রেটে এখান থেকে রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। গরীব ও অসহায় রোগীদের এখানে চিকিৎসা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ এ হাসপাতালের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে গরীব-দুঃখীদের সহযোগিতা করার কথা থাকলেও কোনোরকম সহযোগিতা না করে জাহাঙ্গীর চৌধুরী বছরে ৭৬-৮৪লাখ টাকা নিজস্বার্থে একক সিদ্ধান্তে পছন্দমতো লোকদের ডিসকাউন্ট সুবিধা দিয়ে থাকেন। রোগীসেবার জন্যে চড়ামুল্য নেয়া হলেও এখানে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই, সকলেই এমবিবিএস ডিগ্রিধারী।

হাসপাতালের আজীবন সদস্য করার ক্ষেত্রে রয়েছে লুকোচুরি। সমাজসেবা অধিদপ্তরে ৩৫০০ জন আজীবন সদস্যের রেকর্ড থাকলেও এখানে সাড়ে ৫ হাজারের বেশি আজীবন সদস্য রয়েছে। আজীবন সদস্য হওয়া বন্ধ ঘোষণা থাকলেও জাহাঙ্গীর চৌধুরী ভোটব্যাংক সমৃদ্ধ করতে নিজের মতো করে আজীবন সদস্য করে আসছেন। হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্নে আজীবন সদস্য ফি ছিল ৫শ টাকা এরপর পর্যায়ক্রমে ১হাজার, ২হাজার, আড়াই হাজার, ৫হাজার, ১০হাজার ও সর্বশেষ ১৫হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সহজ পদ্ধতিতে আজীবন সদস্য করা হলে আজীবন সদস্যের সংখ্যা দ্বিগুণ হতো বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এতে করে হাসপাতাল লাভবান হতো। আজীবন সদস্য ফি বাবদ যে টাকা হাসপাতাল তহবিলে আসার কথা, তা যাচ্ছে ব্যক্তিবিশেষের পকেটে।

জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সকল অপকর্মের সহযোগীরা হলেন- চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি এস এম শওকত হোসেন, কোষাধ্যক্ষ এ এস এম জাফর, সদস্য মো. আলী চৌধুরী, সদস্য মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সদস্য অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার তালুকদার, সদস্য মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরী, চিফ এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার মো. আমানউল্লাহ আমান, চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. বেলাল উদ্দিন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শিবু প্রসাদ চৌধুরী। এসব উপকারভোগীকে নিয়ে জাহাঙ্গীর চৌধুরী গড়ে তুলেছেন একটি চক্র। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সকলেই জাহাঙ্গীর চৌধুরীর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও অন্ধ সমর্থক।

এদিকে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৯৬১ সালের ৪৬ নম্বর অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বেচাছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ(রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ)এর ধারা ৯ এর উপধারা(১) মোতাবেক বর্তমান কার্যনির্বাহী পরিষদ সাময়িক বরখাস্তপূর্বক স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থাসমূহ (রেজিস্ট্রেশন ও নিয়ন্ত্রণ)অধ্যাদেশ ১৯৬১ এর ৯(২) উপধারা মোতাবেক মোস্তফা মোস্তাকুর রহিম খান, অতিরিক্ত পরিচালক, বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়, চট্টগ্রামকে প্রশাসক নিয়োগ করেছিল।

পরিপত্রে প্রশাসকের কার্যপরিধি সম্পর্কে বলা হয়-ক. সর্বশেষ অনুমোদিত কমিটির কাছ থেকে অথবা সরাসরি দায়িত্বভার গ্রহণ; খ. ১৯৬১ সালের অধ্যাদেশের আলোকে সমিতির অনুমোদিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যনির্বাহী কমিটির সকল কর্তৃত্ব ও যাবতীয় দায়িত্ব পালন; গ. অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের আলোকে বিধিমোতাবেক সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্নকরণ; ঘ. নির্বাচন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নকরণসহ বিধি মোতাবেক সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচিত কার্যনির্বাহী কমিটির নিকট দায়িত্বভার হস্তান্তরকরণ।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়োগকৃত প্রশাসক মোস্তফা মোস্তাকুর রহিম খান যদি চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব নিতেন তাহলে এ হাসপাতালটিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসতো। কিন্তু এ ফাঁকে বরখাস্তকৃত চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী আবেদন করলে আদালত প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি ছয় মাসের জন্যে স্থগিত করে। গত ১ জুলাই ২০২৩ স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হলেও পুনরায় আবেদন করে মেয়াদ বাড়িয়ে নেয় জাহাঙ্গীর চৌধুরী।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মু. জসীম উদ্দিন ২০২৩ সালের ১১জুলাই মাসে তদন্ত করে ২৭লাখ ৫০ হাজার টাকার দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে সেই টাকা ১৫দিনের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। টাকা জমা না দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও সরকারি কোষাগারে টাকা জমা না দিয়ে পুন;তদন্তের আবেদন করেন জাহাঙ্গীর চৌধুরী। এ অবস্থায় আবার নতুন করে হাসপাতাল সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দুর্নীতি তদন্তের দায়িত্ব পান স্বাস্থ্যমন্ত্রকের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতালে এ তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়।

স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পুনঃতদন্তেও সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের অনুকূলে সরকারি অনুদান প্রদান বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রক এ হাসপাতালকে প্রতিবছর ২কোটি টাকা অনুদান দিয়ে আসছে। হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত সরকারি তহবিল তছরূপসহ স্বজনপ্রীতি,দুর্নীতি এবং সরকারি অনুদানের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এ হাসপাতালের অনুকূলে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ থেকে ১৭,৫০,০০০ টাকা এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ১০,০০০০০ টাকা জরুরিভিত্তিতে চালানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব স্নেহাশীষ দাশ স্বাক্ষরিত ২০ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের এক পরিপত্রে। ব্যর্থ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জাহাঙ্গীর চৌধুরী সরকারি কোষাগারে সেই সাড়ে ২৭লাখ টাকা জমা দেননি। চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশনও জাহাঙ্গীর চৌধুরীর দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। প্রায় ১০০ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে দুদুক।

চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি জাহাঙ্গীর চৌধুরী দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে যারা চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশন, চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক বরাবরে আবেদন করেছেন তারা হাসপাতালটিকে মহাদুর্নীতির রাহুগ্রাস থেকে বাঁচাতে ৫টি প্রস্তাব রেখেছেন, তা হলো- ১.যেহেতু ২০১৫সাল থেকে বর্তমান হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির কোনো বৈধতা নেই সেহেতু এ কমিটির সকল কার্যকলাপ অবৈধ ঘোষণা করে কমিটি বাতিল করা হোক। ২. এডহক কমিটি নিয়োগ দিয়ে সকলের অংশগ্রহণে পরিচ্ছন্ন একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হোক। ৩. সৎ ও যোগ্য লোক দিয়ে আজীবন সদস্যদের তালিকা যাছাই করে হালনাগাদ করা হোক। ৪. অডিট কমিটি নিয়োগ করে হাসপাতালের যাবতীয় হিসাব অডিট করা হোক। ৫. যারা অন্যায় কাজের সাথে জড়িত তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হোক।

‘শৃঙ্খলাই জীবন’-এ স্লোগানকে সামনে রেখে ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা সমাজসেবা থেকে নিবন্ধন নেয়।নিবন্ধনের তিনবছর আগে থেকে চট্টগ্রাম শহরের কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রে ডায়াবেটিক হাসপাতালের বর্হিবিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়।অতঃপর সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ১৯৭৮ সাল থেকে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে, ১৯৮১ সাল থেকে মেহেদিবাগে এবং ১৯৮৮ সাল থেকে এনায়েতবাজারে একটি পরিত্যক্ত ভবনে চিকিৎসা কার্যক্রম চলে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে খুলশী থানাধীন জাকির হোসেন রোডে রেলওয়ের দেয়া প্রায় একএকর জায়গার ওপর নির্মিত নিজস্ব ভবনে হাসপাতালটি স্থানান্তরিত হয়। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে চালু হয় অন্তর্বিভাগ কার্যক্রম। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালটির নামকরণ হয় চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে এ হাসপাতালের ৪টি শাখা আছে। শাখাগুলো- এনায়েতবাজার শাখা, বন্দরটিলা শাখা, অক্সিজেন শাখা ও বহদ্দারহাট শাখা।

উল্লেখ্য, জাহাঙ্গীর চৌধুরীর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে চাটগাঁর বাণী পত্রিকায় ও অনলাইন নিউজপোর্টালে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাহাঙ্গীর চৌধুরী চাটগাঁর বাণীর প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ ও সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিমের বিরুদ্ধে সাইবার ক্রাইম আদালতে মামলা করলেও তা ধোপে টেকেনি, মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

লেখক- প্রধান-সম্পাদক, সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সর্বশেষ

এই বিভাগের আরও