বাংলাদেশের রাজনীতির এক অদ্ভুত প্রহসন হলো নেতাদের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান, আর কর্মীদের প্রাণহীন বিপ্লব। দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সন্তানরা, যেমন শেখ হাসিনা- খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি পর্যায়ের নেতৃত্বের সন্তানরা, বড় হয় উন্নত দেশের আশ্রয়ে, উন্নত শিক্ষায়। তারা শান্তিতে বসবাস করছে, বিদেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে, রাজপথে সেই নেতাদের ঘোষণায় উত্তপ্ত হয়ে যারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তারা সাধারণ কর্মীরা—নেতাদের ঘোষণার সৈনিক।
রাজনীতির এই নির্মম চক্রে ক্ষমতাশীলরা সব সময় নিজে নিরাপদে থাকেন। তাদের সন্তানরা কখনো রাজপথে নেমে স্লোগান দেয় না, কখনো মাঠে পুলিশের মুখোমুখি হয় না, বা প্রতিপক্ষের আক্রমণে আহত হয় না। তারা সুরক্ষিত, তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত। কিন্তু কর্মীরা মাঠে জীবনবাজি রেখে নামছে, জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। এই কাজে তাদের কোনো লাভ নেই। নেতারা বড় হোটেলে আরাম-আয়েশে, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আদেশ দিয়ে যাচ্ছেন, আর সেই আদেশে প্রাণ দিচ্ছে সেই সাধারণ কর্মীরা।
এই ব্যবস্থায় লাভ কার? সাধারণ কর্মী কি কিছু পাচ্ছে? নাকি এই ব্যবস্থায় শুধু সেই মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী লাভবান হচ্ছে যারা হাজার কোটি টাকার মালিক? রাজনৈতিক নেতারা আজ কোটি টাকার সম্পদের অধিকারী, অথচ সাধারণ কর্মী বা মানুষ অল্পতেই তুষ্ট। এই বৈষম্য কোথায় গিয়ে শেষ হবে?
এ দেশের রাজনীতি কি কোনোদিন পাল্টাবে না? সাধারণ মানুষ কি কোনোদিন বুঝবে, এই খেলা তাদের জন্য নয়? হয়তো বা একদিন সাধারণ মানুষ বুঝবে, এই ধোঁকা আর সহ্য করা যায় না। তারা হয়তো বুঝবে, নেতারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়, আর ক্ষতির বোঝা বয়ে বেড়ায় সেই সাধারণ মানুষ। রাজপথে দাঁড়িয়ে জীবন দিয়ে কী লাভ? সেই সামান্য সুবিধা যা নেতাদের সন্তানের জীবনসুরক্ষার তুলনায় কিছুই নয়।
রাজনীতির এই ব্যবস্থায় শুধু স্বার্থের লড়াই, যেখানে রাজা-রাজপুত্রেরা নিরাপদ আর সেই সাধারণ মানুষ জানমালের ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে নামে। এটাই কি রাজনীতির চরম বাস্তবতা—নিরাপদ দূরত্বে বসে নেতৃত্বদান?
রাজনীতির এই প্রহসনের শিকার হয় সাধারণ কর্মী। একদিন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে, দলের প্রতি তাদের এতদিনের বিশ্বাস ফলপ্রসূ হবে, এই আশায় বুক বাঁধে তারা। কিন্তু আদতে যা ঘটে, তা হলো তাদের শেষ পরিণতি—একজন সাধারণ কর্মীর নিঃস্ব জীবন, যেটা শেষ হয়ে যায় রাস্তায়, গুলিতে কিংবা লাঠির আঘাতে। আর এই মৃত্যুতে কোনো পরিবর্তন আসে না, শুধু আসে আরেকটি নামে আরেকটি মুখ, যে একই বিশ্বাসে রাজপথে নামে।
শেষ পর্যন্ত, যখন রাজনীতির খেলা শেষ হয়, বেঁচে থাকে রাজা আর তার বংশধর, মরে যায় সেই সাধারণ।
লেখকঃ শিক্ষক ও সাংবাদিক।